মহাশ্বেতা দেবী : টুকরো স্মৃতি

মহাশ্বেতা দেবী (১৯২৬–২০১৬) : নবম বা দশম শ্রেণী থেকে তাঁকে চিনি, পড়ছি তাঁর বই – গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে এসে তাঁকে রাজশাহীতে পাওয়া এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। [. . .]

মহাশ্বেতা দেবী (১৪ জানুয়ারি ১৯২৬ – ২৮ জুলাই ২০১৬)

মহাশ্বেতা দেবী (১৪ জানুয়ারি ১৯২৬ – ২৮ জুলাই ২০১৬)

মনে পড়ছে না ঠিক কবে, সম্ভবত ১৯৯৬-এর দিকে, মহাশ্বেতা দেবী বাংলাদেশে এসেছিলেন। ভারত-বাংলাদেশের একটি চমৎকার সাংস্কৃতিক লেনদেনের অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতা-সূত্রে। সেই বছরই তিনি ভারতে সাহিত্যিকদের শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘জ্ঞানপীঠ পুরস্কার’ পান।

নবম বা দশম শ্রেণী থেকে তাঁকে চিনি, পড়ছি তাঁর বই –  গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে এসে তাঁকে রাজশাহীতে পাওয়া এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। আমাদের ক্যাম্পাসেই, আমাদের বাসাবাড়ির ঠিক পেছনে হাসান আজিজুল হকের বাড়িতে উঠেছেন। কী উৎসবের ব্যাপার!

সাঁওতাল পল্লী থেকে একজন এসে তাঁকে তাদের পরগনায় নিয়ে যাবে – এমন প্রত্যন্ত কোনাতেও তারা ঠিক তাঁকে চেনে।… ‘সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে!’

হাসান চাচাদের বাড়ির সেই সময়ের বোধকরি সবচেয়ে পরিশ্রমী মানুষ, তাঁর কন্যা শবনম সুমন (আমাদের সুমন আপা) – সকাল থেকে সন্ধ্যে কতো না কাজ করছেন। সুমন আপা সেই বাড়ির কাজের ফাঁকেই বোধহয় একটু নম্র ইচ্ছে দেখিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে যাবার – অমনি তিনি বলে বসলেন, সুমন না গেলে আমিও যাব না। ব্যাস হয়ে গেল – বাড়ির কাজকম্ম ফেলে সুমন আপাকে প্রায় কোলে নিয়ে তাঁরা বিরাট গাড়ি করে চললেন সাঁওতাল পল্লীতে। আমরা শুনে হাত চিবালাম আরকি!

পরে সুমন আপা বললেন, ‘মাসি-কে ওখানে গিয়ে আমরা আর চিনতেই পারছিলাম না। আমাদের এমন আপনজন, তখন যেন ওদেরই একজন। অল্প সময়ের মধ্যে তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, নাচ, গান, জলের ব্যবস্থা, সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন করে জানা হয়ে গেল তাঁর। তারপর প্রায় সত্তর বছরের তরুণী নাচ করলেন তাদের সঙ্গে!’ আহা – সত্যজিতের শেষ ছবি ‘আগন্তুক’ থেকে সেই শেষের দিকের মনোরম নাচের দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে শুনে!

ফিরেও তাঁর তেজোময়তা। দেখলাম ইনসুলিন ইনজেকশন নিচ্ছেন, কথার ফাঁকে পায়ের গোড়ালি ঘুরিয়ে ব্যায়াম করে নিচ্ছেন। বেশ মজার লোক এই সব লেখকেরা – মোটেও গুরুগম্ভীর নন! বললেন ৯৯ বছর অব্দি বাঁচবেন। কথাটা এমন আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছিলেন! হাসান চাচা জিজ্ঞাসা করলেন, সেঞ্চুরি করবেন না? উনি তার উত্তরে বললেন, না ৯৯-ই ঠিক, সেঞ্চুরি করতে চাই না! আহা! আর নয়টা রান বাকি থেকে গেল তাঁর!

আমি এদিকে ভাবছি, যিনি দু-হাতে লেখেন আর সমাজের আনাচে কানাচে কাজ করে বেড়ান, ডায়বেটিস তাঁকে একটুও দমাতে পারে না – কী আত্মশক্তি! বললেন, একটু হিসেব করে চললে, একশ বছর বাঁচা যায়। যেন বাতলে দিচ্ছেন খেলায় জিততে গেলে কী কৌশল জানতে হয়!

কথাবার্তা হচ্ছে, সকলে চলে গেছে। আমি কেন জানি যাব না বলেই থেকে গেছি। বাবাও। হাসান চাচা আর মহাশ্বেতা দেবী স্নান করে এলেন। মলয় ভৌমিক (‘অনুশীলন’ নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, নাট্যকার, নাট্যশিল্পী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক) – মলয় কাকা এসেছেন, ‘সংবাদ’-এর জন্য একটা সাক্ষাৎকার নেবেন। এমন সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়? টেপ রেকর্ডারের জমানা – তাই বেশ ক্যাসেটবন্দী হল সব।

সাক্ষাৎকার নেবার পরদিন শুনলাম, সর্বনাশ হয়েছে, দুই ঘণ্টার সাক্ষাৎকারের অনেক কিছু বোঝা যায় না! এখন কী করণীয়? কাঁচা বয়েসের আবেগে গদগদ আমি স্বেচ্ছায় সঙ্গে-সঙ্গে সেই টেপ শুনে শুনে লিখতে বসে গেলাম। আর কী ভাগ্য, কালিদাসের জিভে সরস্বতী ধরা পড়ার মতো ব্যাপারটা যেন অনেকটাই সহজ হয়ে গেল!

সেই সাক্ষাৎকারের অনেক কথাই তো ভুলে গেছি, তবু মনে আছে যে উনি বলেছিলেন, একটা ভাষা খুব ভালো করে শিখলে অন্য ভাষা শিখতে অসুবিধে হয় না। মনে পড়ে সেই সূত্রে, ইংলিশে গ্রাজুয়েট অনেক প্রোথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক আছেন, তিনি তাঁদের অন্যতম।

মহাশ্বেতা দেবীর সেইবারের সফরসঙ্গী ছিলেন সদ্যপ্রয়াত আমাদের সকলের শ্রদ্ধার মানুষ মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল। আশ্চর্য, কয়েক দিনের ব্যবধানে চলে গেলেন দু’জন! মহাশ্বেতাকে ছেড়ে কেউ তাঁর কথা বলতে গেছে তো তিনি বলে উঠছেন, আমি শুধু সঙ্গে এসেছি, আমি কেউ না! কী অমায়িক আর বিনয়ী মানুষ!

অনেকের মতো আমিও একসময় তাঁর বই পড়তে খুব ভালোবাসতাম। জিম করবেটের অনুবাদ পড়া হয়নি –  শিকারের বই আমি ভালোবাসি না বলেই কি? তবে সত্যজিৎ রায় সম্পাদিত ‘সেরা সন্দেশ’-এ তাঁর অনবদ্য গল্প পড়েছিলাম। এখনো পেলে পড়ি আবার।

কিছু দিন পরে তাঁর ‘হাজার চুরাশির মা’ অবলম্বনে গোবিন্দ নিহালনির হিন্দি ছবি ‘হাজার চৌরাশি কি মা’ দেখে একটু হতাশ হয়েছিলাম – সেই আবেগ পাইনি কিনা। তবে সেটে তিনি ছিলেন বলে শুনেছিলাম।

আরো পরে আমার প্রিয় বন্ধু মঞ্জীর তাঁর কাছে যায় এবং তাঁর সংগঠনের হয়ে কাজ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করে। সেই বিবরণ ভালো করে শোনার ইচ্ছে থেকেই গেল। (মঞ্জীর কাজের মানুষ, নিজের ব্যবসা নিজে গড়েপিটে তৈরি করেছে ছোটো বয়েসে, এখন সাধারণ ছেলেমেয়েদের হস্তশিল্পের ওপর প্রতিষ্ঠিত তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ‘ফোক’।)

বীরসা মুণ্ডারা মরে না – ফিরে আসে, সেই আশা ও শিহরন তিনি আমাদের তরুণ রক্তে মিশিয়ে দিয়েছিলেন  ‘অরণ্যের অধিকার’-এ। বেশ কিছু ছোটোগল্প ও উপন্যাসের বই সংগ্রহ করেছিলাম, কিন্তু বহুবার আবাস পরিবর্তনের ফেরে সেসব হারিয়ে গেছে কে কোথায়। প্রিয় মানুষের মতো, খুঁজে খুঁজে বের করা প্রিয় লেখকের প্রিয় বই।

তাঁর চলে যাওয়ায় আমার তেমন কান্না নেই – কারণ তিনি সঙ্গে থাকবেন, তরুণ বয়েসে হারিয়ে যাওয়া শক্তিশালী প্রিয় লেখক আবার পড়ার টেবিলে ফিরে আসবেন, যাদের কেউ নেই কিছু নেই, তাদের সম্বল হবেন, যারা সঙ্গে থাকতে চেয়েছিল স্বপ্নে সংগ্রামে, তাদের ফিরিয়ে দেবেন হয়তো দ্রুত-হারিয়ে-যেতে-থাকা কোনো অরণ্যের অধিকার।

৩ comments

  1. মাসুদ করিম - ২৯ জুলাই ২০১৬ (৬:৩২ অপরাহ্ণ)

    উজ্জ্বল এক বাতিঘর

    হাসান আজিজুল হক

    এ সময়ের প্রধান লেখকদের একজন মহাশ্বেতা দেবীর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে আমি মর্মে মর্মে বেদনা অনুভব করছি। কারণ, তার সঙ্গে আমার খুব অন্য রকম একটা সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি রাজশাহী এসেছিলেন। সে সময় আমার বাসায় অবস্থান করেছিলেন। আমার এক মেয়েকে কাছে নিয়ে রাতে ঘুমিয়েছিলেন।

    বাংলা সাহিত্যে সত্যিকার অর্থে মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে ও সমাজের নিম্নস্তরে গিয়ে তাদের সুখ-দুঃখের অংশী হয়ে সাহিত্য রচনার তেমন কোনো ইতিহাস তো নেই। তিনি রাজশাহী এসে উত্তরবঙ্গের সমতলভূমির আদিবাসীদের গ্রামগুলোতে যেতে চেয়েছিলেন এবং গিয়েছিলেনও। তিনি গ্রামে ঢুকে আদিবাসী বৃদ্ধের হাত থেকে পানিতে ডোবানো আম্রপল্লবসহ একটা বড় ঘটি উপহারও পেয়েছিলেন। সেখানে আদিবাসীদের সঙ্গে কথা শুরু করার আগে তিনি মাটির ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে মাতৃভূমিকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। ওরা তাকে বাড়িতে প্রস্তুত পানীয় তুলে যখন দিলেন, তখন উনি বললেন, ‘তোরা দিচ্ছিস যখন আমি একটু ঠোঁট ছোঁয়ালাম। কিন্তু তোদের বলছি, তোরা মদ খাস না, মদ তোদের খায়।’ আমি এ রকমভাবে কোনো লেখককে এত সাধারণভাবে কথা বলতে এবং অধিকার প্রয়োগ করতে আর দেখিনি।

    পশ্চিমবঙ্গে কলকাতায় তার ছোট্ট বাড়িতে দুটি ঘরের একটিতে তিনি তার শোবার খাটখানা নিয়ে এসেছিলেন। আমি সেখানে যেতেই বললেন, ‘এখন এই ঘরেই শুচ্ছি, আর এখানে বসার সুবিধা হচ্ছে না। নিজের ঘরে একজন আদিবাসী রোগী রয়েছে, তার সেবা-শুশ্রূষা করতে হয়, তাকেই ঘরটা ছেড়ে দিতে হয়েছে।’

    লোঝা গ্রামের বাসিন্দা ছিল সে। আমাদের দেশের ওঁরাও, চামুন্ডাদের চেয়ে এদের সামাজিক অবস্থান নিচে। তার কথা শুনে আমি লোঝাদের গ্রামে গিয়েছিলাম। রাষ্ট্র কীভাবে শোষণ ও বঞ্চনার মধ্যে মানুষকে জীবনযাপন করতে বাধ্য করে, তা আমি তখন দেখেছিলাম। মহাশ্বেতা দেবী-ই আমাকে চিনিয়েছিলেন।

    ‘অরণ্যের অধিকার’ নামে তার বিখ্যাত একটি বই আছে। ‘চোট্টিমুণ্ডা এবং তার তীর’ বলে তার একটা বই আছে। নকশাল আন্দোলনের ভয়ঙ্কর চিত্র তিনি ‘হাজার চুরাশির মা’ নামের সুবিখ্যাত উপন্যাসে তুলে ধরেছিলেন। জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সাহিত্য সৃষ্টির যে উদাহরণ এই ৯০ বছর পর্যন্ত যিনি দেখিয়ে গেলেন, তিনি তো আসলে আমাদের লেখকদের জন্য এক উজ্জ্বল বাতিঘর। সেই কবে থেকে পড়ছি মহাশ্বেতা দেবীর লেখা। তখন ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় একটা উপন্যাস বের হচ্ছিল। ওই সময়ই বের হয় তার ‘ঝাঁসির রাণী’ বইটি।

    তিনি যখন জ্ঞানপিঠ পুরস্কার পেলেন, আমি তখন কলকাতায় ছিলাম। তাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য টেলিফোন করতেই তিনি বললেন, ‘তুমি অন্তত আমাকে অভিনন্দন জানিও না। এটা তোমরাই পেয়েছ।’

    এমন অনেক কথা কখনও হয়তো তার সম্পর্কে আমাকে লিখতে হবে। পরে হয়তো আমি বিস্তারিত লিখব; এ মুহূর্তে আমি তার মৃত্যুর সংবাদে হতবিহ্বল হয়ে আছি।

    মাত্রই পেলাম তার মৃত্যুসংবাদ- কেবল মনে হচ্ছে, এভাবেই সকলকে চলে যেতে হয় একে একে; আমাদের পরম সুহৃদ মহাশ্বেতা দেবীও চলে গেলেন; এই তো মনে হচ্ছে, তার সরল অথচ দৃঢ় মুখখানা, যিনি সব মানুষকে সমান চোখে দেখতে জানতেন; চাইতেন সকলের সমঅধিকার- এমন মানুষের মৃত্যু হয় না। মহাশ্বেতা দেবী তার অজস্র রচনায়, আসামান্য জীবনচর্যায় রয়ে যাবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা, গভীরতম ভালোবাসা। ভালো থাকবেন আমাদের বাতিঘর- মহাশ্বেতা দেবী।

  2. মাসুদ করিম - ২৯ জুলাই ২০১৬ (৬:৩৩ অপরাহ্ণ)

  3. Pingback: মহাশ্বেতা দেবী ও আমার স্মৃতি

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.